সারিবদ্ধ চুলায় বড় ৩০টি ডেকে চলছে রান্না। বাবুর্চি আছেন ৫ জন। কর্মী আরও ১০ জন। রান্না শেষ হলেই এক পরিবারের পাঁচজন খেতে পারে—এই পরিমাণ খিচুড়ি ভরা হচ্ছে একটি প্লাস্টিকের বাক্সে। প্রতিটি বাক্সে দেওয়া হচ্ছে পাঁচটি সেদ্ধ ডিম। এরপর এক হাজার বাক্স বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে সেনাবাহিনীর কাছে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা সেগুলো নিয়ে ছুটে যান প্রত্যন্ত গ্রামের বন্যাকবলিত মানুষের মধ্যে।
সুনামগঞ্জ শহরের সরকারি জুবিলি উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস প্রাঙ্গণে গিয়ে আজ শনিবার সকালে এমন কর্মযজ্ঞ চোখে পড়ে। ভয়াবহ বন্যায় আক্রান্ত সুনামগঞ্জের মানুষকে খাওয়ানোর জন্যই এ আয়োজন। আর এটি করা হচ্ছে দুটি ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনায়। টানা এক সপ্তাহ জেলার বন্যার্ত ৪০ হাজার মানুষকে এক বেলা এভাবেই দেওয়া হবে এ খাবার। প্রয়োজনে এ খাবার বিতরণ কার্যক্রমের সময় আরও বাড়ানো হবে বলে জানিয়েছেন ট্রাস্টের লোকজন।
সুনামগঞ্জে বন্যার্তদের খাবার বিতরণের এ উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রামের ‘আলহাজ মোস্তফা হাকিম ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট ও আলহাজ হোসনে আরা মনজুর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’। এই ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক হলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলম।
সুনামগঞ্জে বন্যার্তদের মধ্যে খাবার বিতরণ কার্যক্রমের সমন্বয়ে থাকা মোহাম্মদ পারভেজ জানান, তাঁরা সুনামগঞ্জে এসেছেন গত বৃহস্পতিবার। গতকাল শুক্রবার থেকে তাঁদের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ৪০ হাজার মানুষকে এক বেলা খাবার প্রস্তুতের প্রয়োজনীয় সব সামগ্রী, লোকবলসহ সবকিছু চট্টগ্রাম থেকেই নিয়ে এসেছেন। তাঁদের সঙ্গে আছে চারটি ট্রাক ও দুটি বাস আছে। লোকজন আছেন ৩০ জন। খাবার তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় সব চাল, ডাল, ডিম, তেল, পেঁয়াজ, প্লাস্টিকের বাক্সসহ যা যা প্রয়োজন, সবই আনা হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, চুলা তৈরির জন্য এক হাজার ইট, প্রয়োজনীয় লাকড়ি পর্যন্ত তাঁরা নিয়ে এসেছেন সঙ্গে করে।
প্রথম দিন রান্না করা খাবার দেওয়া হয়নি। ওই দিন এক হাজার মানুষকে দেওয়া হয়েছে খাদ্যসামগ্রীর প্যাকেট। গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুরু হয় রান্নার কাজ। গতকাল এক হাজার মানুষের এক বেলার খাবারের বাক্স তুলে দেওয়া হয় সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাতে। সেগুলো সদর উপজেলার কাঠইর ও মোহনপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে বিতরণ করা হয়। আজকের বিতরণের জন্য নেওয়া হয়েছে একই উপজেলার লক্ষ্মণশ্রী ও মোল্লাপাড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁদের একজন প্রতিনিধি থাকেন খাবার বিতরণের সময়।
এ কাজে যুক্ত থাকা আরেক ব্যক্তি মোহাম্মদ জিসান জানান, প্রতিটি বাক্সে একটি পরিবারের পাঁচজন খেতে পারবেন—এ পরিমাণ খিচুড়ি দেওয়া হয়। সঙ্গে থাকে পাঁচটি ডিম। রাত ১২টায় রান্না শুরু হয়। এতে ভোর হয়ে যায়। পরে তাঁদের সঙ্গে আসা ট্রাস্ট পরিচালিত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিএনসিসির কর্মীরা শুরু করেন প্যাকেট করার কাজ। সকাল ১০টার মধ্যে সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসে এগুলো বুঝে নিয়ে যান।
মোহাম্মদ পারভেজ জানান, এগুলো বন্যার্তদের মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তাঁরা দুটি বিশেষ বোট দিয়েছেন সেনাবাহিনীকে। এই বোটগুলোও চট্টগ্রাম থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। পারভেজ বলেন, ‘আমরা সব প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি। সুনামগঞ্জ থেকে কোনো কিছুই কিনতে হবে না। আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে আগেই সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগযোগ করা হয়। তারাই আমাদের কাজের জন্য এই জায়গা নির্ধারণ করে দিয়েছে।’
সুনামগঞ্জ শহরের বাসিন্দা তরুণ ব্যাংকার আশরাফ লিটন বলেন, ‘আমি দেখতে এসেছি। চট্টগ্রাম থেকে সুনামগঞ্জে এসে তাঁরা আমাদের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। দেখে মনে হলো, এ এক বিরাট কর্মযজ্ঞ। ট্রাস্টের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সুনামগঞ্জবাসীর পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই।’
ট্রাস্ট দুটির পরিচালক সরোয়ার আলম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের এই ট্রাস্ট দুটির মাধ্যমে ৮১টি প্রতিষ্ঠান সারা বছর নানা সামাজিক কাজ করে থাকে। একই সঙ্গে যেখানেই প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ হয়, মানুষ বিপাকে পড়ে, আমরা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দ্রুত তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। সুনামগঞ্জে বন্যায় সৃষ্ট দুর্যোগের সংবাদ পেয়েই আমরা মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিই।’ সুনামগঞ্জে প্রয়োজন হলে এই কার্যক্রমের সময় আরও বাড়াবেন বলে জানালেন সরোয়ার আলম।
সুনামগঞ্জে ১৬ জুন থেকে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। মানুষের বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত, সবই তলিয়ে যায় বানের জলে। সুনামগঞ্জ সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল টানা চার দিন। সুনামগঞ্জের বন্যাকবলিত মানুষ এখন চরম খাদ্যসংকটে আছে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি নানা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এসব দুর্গত মানুষকে নানাভাবে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।
source: প্রথম আলো
Recent Comments